হাতছানি
– রাখী চক্রবর্তী
প্রথম দৃশ্য:
যা বলছি যা।;একদম আমার কাছে আসবি না।
– আমি তো তোমার কাছে আসতে চাইনি।তুমিই তো আনতে চেয়েছিলে আমায়।
-না আমি ভুল করেছিলাম।
– তাহলে আমাকে তোমার ভুলের সাজা কেন পেতে হল?
– জানি না আমি জানি না।
-কি হল পাপিয়া, ঘুমের ঘোরে এত চিৎকার করছো? উঠে বসো একটু ধাক্কা দিয়ে পাপিয়াকে ঘুম থেকে তুলল মানস।
– ও এসেছিল আমাকে খুন করতে।
– কে এসেছিল ?
-ও এসেছিল। ওর হাতে কাঁটা চামচের মতো একটা জিনিস ছিল। আমার পেটের দিকে তাক করা ছিল ঐ জিনিসটা। আর বলছিলো আমাকে শত আঘাত দিয়ে শেষ করে দেবে ।
– কে সে? কিছু তো বলো।
– আমাদের প্রথম সন্তান। জন্ম নেওয়ার আগেই যাকে ডাক্তারের সাহায্য নিয়ে আমি শেষ করে দিয়েছিলাম। কি ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে আমার বাচ্চা টাকে। সারা গায়ে ওর ফুটো ফুটো। রক্তে মাখা ওর দেহ।
– অনেক বার আমি বারণ করেছিলাম। তুমি তো আমার কোন কথাই শোননি সেদিন।লোক লজ্জার ভয়ে এই পাপ কাজটা তুমি করেছিলে সেদিন। কতই বা বয়স ছিল ওর চার মাস।
সেই তো আমাদের বিয়ে হল।
আমি বা কি করতাম। লোক লজ্জার ভয়ে এই ঘৃণিত অপরাধটা আমি করেছিলাম।আমি বাঁচতে চাই মানস। আমাকে বাঁচাও ওর হাত থেকে।
রাত দুটো বাজে পাপিয়ার চোখে ঘুম নেই।
কখন আসবে ও!
রাত তিনটে,
মা মা আমার কাছে এসো, একটু আমার পেটে হাত ভুলিয়ে দেবে। খুব জ্বালা করছে সারা শরীর।
পাপিয়া চোখ খুলে দেখলো, বাচ্চাটা ধারালো অস্ত্র নিয়ে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে।
– না, অনেক ভয় পেয়েছি আর না। মারবি তো? দেখি কেমন মারতে পারিস।
হা হা হা ভয়ে পালিয়ে গেলি
পাপিয়ার হাসি শুনে মানসের ঘুম ভেঙে গেল।
পাপিয়া কোথায় যাচ্ছে এতো রাতে? দরজা খুলে পাপিয়া রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। মানসও পাপিয়ার পেছন পেছন ছুটছে। কিছুক্ষণ পর পাপিয়া লুটিয়ে পড়ল রাস্তায়।মানস মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে রাস্তার ওপর। ঘন অন্ধকার রাত কে আসবে ওদের সাহায্য করতে? আর পাপিয়ার শরীর এতো ভারি হয়ে গেছে মানস কিছুতেই ওকে তুলতে পারছে না। ভোর হওয়ার অপেক্ষাতে বসে থাকল মানস।
দ্বিতীয় দৃশ্য:
ভোরের আলো জানলা দিয়ে ঢুকে পাপিয়ার মুখে এসে পড়তেই পাপিয়া ধড়ফড় করে উঠে পড়ল । চোখ খুলে দেখল খাটে রজনীগন্ধার ফুল গোলাপের পাপড়ি। তাহলে ওটা স্বপ্ন ছিল?
ওও গড! স্বপ্ন দেখে এতো ভয় পেয়েছিলাম।ব্লাডি রাসকেল মানসকে অনেক দিন পর দেখলাম তাও আবার স্বপ্নে। খুব শখ ছিল আমাকে বিয়ে করার। মাল করি নেই, আমাকে ভালো রাখবে বিয়ে করে- যত্তসব।কিন্তু বেচারা দিনুবাবু কি বাড়ির সবাইকে কাল রাতের ঘটনা বলে দিল? না মনে হয়।
– নতুন বৌ আর কত দেরি করে ঘুম থেকে উঠবে। আত্মীয় স্বজন ভর্তি বাড়িতে। এরাই আবার রটিয়ে দেবে নতুন বৌ বেলা নটা পর্যন্ত ঘুমায়।
-দিনু যাও বৌমাকে ঘুম থেকে তুলে আমাদের উদ্ধার করো।
দিনু মাথা চুলকে বললো আমি ডাকতে পারব না।
দিনু লজ্জার কথা কি করে বাড়ির সবাইকে বলবে! ফুলশয্যার রাতে দিনু ঘরে ঠাঁই পায়নি। ব্যালকনিতে বসে সারা রাত ঝিমিয়েছে।
তৃতীয় দৃশ্য:
পাপিয়া মুখ ধুয়ে বাড়ির সবাইকে শুভ সকালের শুভেচ্ছা জানিয়ে বারান্দায় এসে বসলো। চা আসবে এবার, বিস্কুট যদি পছন্দের না হয়েছে তাহলে…
– কি বিড়বিড় করছো বৌমনি? এই নাও চা।
-ঠাকুরের নাম করছি।
-ওও তাই বলো। রাতের বেলায় ঘুম হয়ে ছিল তো।
-ছোট ছোটর মতো থাকো।
কলেজে পড়ে মলি। দিনুর একমাত্র বোন।বৌমনির কাছ থেকে এরকম উত্তর আশা করেনি ও।
সকাল দুপুর হাসি গল্পে কাটল বাড়ির সবার।শুধু দিনু পাপিয়ার থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলছে। কত স্বপ্ন দেখেছিল দিনু পাপিয়াকে নিয়ে।
বিকেল বেলায় সবাই মিলে সাফারি পার্কে ঘুরতে গেল। নতুন বৌকে বাড়ির সবাই খুব পছন্দ করছে হাসিখুশি মেয়ে পাপিয়া।মানিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে খুব তাড়াতাড়ি।
চতুর্থ দৃশ্য :
রাত দশটা বাজে বাড়ির সবাইকে শুভ রাত্রির শুভেচ্ছা জানিয়ে পাপিয়া নিজের ঘরে এল। দিনু তার আগেই ব্যালকনিতে গিয়ে সোফার ওপর শুয়ে ছিল। দিনু রাতে তেমন ঘুমাচ্ছে না। সুন্দরী স্ত্রী ঘরে অথচ দিনু একা একা রাত কাটাচ্ছে। যাই হোক
দিনুর জাগনা ঘুম। পাপিয়ার বকবকানিতে ঘুম ভেঙে গেল। তখন রাত দুটো বাজে। কিন্তু কার সাথে কথা বলছে পাপিয়া? ঘরের ভেতরে কে আছে এতো রাতে!
কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে ঘরের দরজাটা ফাঁক করে দিনু দেখল, পাগলের মতো আচরণ করছে পাপিয়া। ঘরে তো কেউ নেই।
পাপিয়া বলছে, আমাকে ছেড়ে দে। মারিস না। তুই এবার আসবি আমার কোকে। আমি তোর মা হব। বড়লোকের ছেলে হয়ে জন্ম নিবি তুই। তোর মাকে ক্ষমা করে দে। তুই মনের মতো জীবন পাবি বাবা, সত্যি বলছি।
তোর ঐ বাবা ভাখিরি ছিল ও আজন্ম ভিখিরি থাকবে। কাছে আসিস না বাবা…
দিনু সব দেখেশুনে হতবাক হয়ে গেল। কি সব বলছে পাপিয়া। ওর সন্তান কবে হল।তবে কি বিয়ের আগে…
দিনু দরজাটা ভেজাতে যাবে ঠিক তখুনি ক্ষত বিক্ষত পাপিয়া খাট থেকে মেঝেতে পড়ে গেল। কি রক্ত..! দিনু দেখলো একটা ছোট্ট শিশু গুটিগুটি পায়ে বক্স জানলার ওপর থেকে ঝাঁপ মারলো। এই দৃশ্য দেখার পর দিনু অজ্ঞান হয়ে গেল। পরদিন ভোর বেলায় দিনুর জ্ঞান ফিরলূ। বাড়ির সবাইকে পাপিয়ার কথা বলল। পুলিশ এল, দিনুর কথা বিশ্বাস তো দুর..উল্টে দিনুকেই খুনি মনে করছে পুলিশ ।
পঞ্চম দৃশ্য:
ফুলশয্যার পরের রাতে নববিবাহিত বধু খুন। নিউজ পেপার, টিভিতে গম গম করে খবর গরম হচ্ছে। মানসের কানেও গেছে কথাটা। মানস পাপিয়ার মার কাছে ওর মৃত্যু রহস্য জানার জন্য গেছে সেই সময় দিনুকে নিয়ে পুলিশ গেছে পাপিয়ার মার বাড়িতে।
পাপিয়ার মা পঙ্গু হয়ে বিছানায় শয্যা নিয়েছেন গত পাঁচ মাস হল। নিজের মেয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে জেনেও তিনি কিছুই করতে পারলেন না। শুধু চোখের জল ফেলছেন।
পাপিয়ার মাকে দিনু আগের রাতের ঘটে যাওয়া সব কথা বলছে তখন মানস আর চুপ করে থাকতে পারলো না। কিভাবে গর্ভের শিশুকে নার্সিং হোমে গিয়ে হত্যা করেছে পাপিয়া সে সব ঘটনা পুলিশের সামনে তুলে ধরলো। দিনুও সবটা জানে পাপিয়ার কথাতে।
পাপিয়ার মৃতদেহ পঞ্চনামার জন্য নিয়ে গেল। কাঁটা চামচের ফিংগার প্রিন্টে কচি হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। কিছুতেই পুলিশ বিশ্বাস করতে পারছে না, কিভাবে কচি হাত রহস্য জনক ভাবে খুন করলো নববিবাহিতা বধূকে।
মানস দিনুকে ওদের ভালবাসার কথা সব বললো।
পাপিয়া লোভী তাই ভালবাসার থেকে টাকার মূল্য ওর কাছে অনেক বেশি। তাই ধনী দিনেশ কুণ্ডুকে বিয়ে করতে উঠে পড়ে লেগেছিল পাপিয়া। মানস একটা ছোট কোম্পানিতে চাকরি করে তাই মানস ভিখিরি। মানসের চালচলন কথাবার্তা পোশাক এই সব দেখে পাপিয়া ওর প্রেমে পড়ে ছিল। কয়েক মাস পর পাপিয়া জানতে পারে মানসের আর্থিক অবস্থা ভালো না।বিবাহযোগ্যা বোন আছে। কিন্তু ততদিনে ওদের শারীরিক মিলন হয়ে গেছিল। গর্ভের সন্তানকে হত্যা করার জন্য পাপিয়া পাঁচ হাজার টাকা চেয়েছিল মানসের কাছে। মানস অতি কষ্ট করে পাঁচ হাজার টাকাও দিয়েছিল পাপিয়াকে। অবশ্য দিতে বাধ্য হয়েছিল। মানস পাপিয়াকে বিয়ে করবে বলে আশ্বাসও দেয়। কিন্তু তা পাপিয়া হতে দিল না। পাপিয়া না পেল টাকার স্বাদ না পেল মাতৃত্বের স্বাদ ।
শেষ দৃশ্য:
দিনু, মানস ও আরো অনেক আত্মীয়, প্রতিবেশী পাপিয়ার মৃতদেহ সৎকারের জন্য শ্মশানে নিয়ে গেল।
পাপিয়ার মুখাগ্নি মানস করল। দিনু মানসকে অনুরোধ করেছিল এটা করার জন্য। দিনু তো নামে মাত্র স্বামী ।
চিতায় জ্বলছে পাপিয়ার দেহ। মানস ও দিনু দেখল একটা ছোট্ট শিশু আগুনে ঝাঁপ দিল । দু’ হাত বাড়িয়ে মানস ওর সন্তানকে ধরতে গিয়েও হাত গুটিয়ে নিল। দিনু বললো, মায়ের কোল পেল শিশুটি এবার। পরের জন্মে ঠিক মার আদর ভালবাসা পাবে ছোট্ট শিশুটি।
দিনু ও মানস চোখের জল ফেলতে ফেলতে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। তখন ভোরের আলোতে আকাশটা একটু স্বচ্ছ হচ্ছে মানস আকাশের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে বললো দিনু ঐ দেখো পাপিয়া আমার সন্তানকে কোলে নিয়ে আদর করছে। আর আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
দিনু আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল। সত্যি তো মেঘের কোলে পাপিয়া নিজের সন্তানকে কোলে নিয়ে আদর করছে। মানস দু’ হাত তুলে বললো, আমাকে নিয়ে যাও পাপিয়া এই সুখ আমারও যে প্রাপ্য ।
ভয়ঙ্কর গল্প …